জয়া ঘরে ঢুকে দেখলো সারাহর ডায়রিটা খোলা অবস্থায় টেবিলের উপর পড়ে আছে। অন্যের ডায়রি পড়া উচিত না, কিন্তু গোটা গোটা অক্ষরে লিখা শিরোনামটা দেখে চমকে গেল জয়া! আনমনেই ডায়রিটা হাতে তুলে নিয়ে পড়া শুরু করল,
"শিরোনামঃ কীভাবে হারাম সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসবো?এও কি সম্ভব? "
সবার আগে আমাকে নিজের সাথে নিজের মানসিক যুদ্ধ জিততে হবে। আমি কি সত্যি বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ আমাকে যা করতে বলেছেন সেটাতেই কল্যাণ আর আল্লাহ যেটা করতে বারণ করেছেন সেটাতেই অকল্যাণ? আমি কি এটা মানি যে, আমার কল্যাণ কোথায় এটা আল্লাহর থেকে ভালো কেউ জানে না? আমি যদি মনে করি আমি নিজে আল্লাহর থেকে বেশি বুঝে ফেলেছি তাহলে সমস্যা অনেক বড়। কিন্তু, আলহামদুলিল্লাহ আমি জানি যে, আল্লাহ যা আমাকে করতে বলেছেন সেটাই ঠিক! আল্লাহ বলেছেন, বিয়ের বাইরে প্রেমের সম্পর্কে না জড়াতে। তার মানে এটাই আমার জন্যে ভালো এবং সেটা মনে প্রাণে আমাকে মানতে পারতে হবে।
আল্লাহ আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। আমার মাও আমাকে অনেক ভালবাসেন। কোন কারণে আম্মু আমার উপর অসন্তুষ্ট হলে আমার অনেক খারাপ লাগে। আর যেই আল্লাহ আমাকে জীবনের সব দিলেন, তাঁকে অসন্তুষ্ট করতে আমার একটুও খারাপ লাগে না? ছিঃ সারাহ! ধিক্কার তোমাকে!
আচ্ছা ধরলাম আমার ঈমান এখনো অনেক দুর্বল। আল্লাহকে আমি এখনো নিজের থেকে বেশি ভালবাসতে পারিনি। আল্লাহকে ভালোবাসতে না পারলাম, কিন্তু নিজেকে তো ভালবাসি? নিজের ভালোর জন্যেই আমি তাহলে থামি? বয়ফ্রন্ডের সাথে টানা চারদিন কথা না হলে মনের কষ্টে ফোন দিয়ে দেই! হায়রে আমি দুর্বল! এতটুকু মানসিক কষ্ট সহ্য করতে পারি না, জাহান্নামের আগুন কিভাবে সহ্য করবো? নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে, আমি কেন বুঝি না?
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুখারীর হাদিসে তার স্বপ্নের বর্ণনা এভাবে দেন, “জিবরাঈল ও মীকাঈল (আলাইহি সালাম) আমার কাছে এলেন এবং আমি তাঁদের সাথে পথ চলতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে আমরা বড় একটা চুল্লির কাছে এসে পৌঁছলাম। সে চুল্লির উপরের অংশ সংকীর্ণ ও নিম্নভাগ প্রশস্ত। ভেতরে বিরাট চিৎকারও শোনা যাচ্ছিল। আমরা চুল্লিটার ভেতরে দেখতে পেলাম উলংগ নারী ও পুরুষদেরকে। তাদের নিচ থেকে কিছুক্ষণ পর পর এক একটা আগুনের হলকা আসছিল আর তার সাথে সাথে আগুনের তীব্র দহনে তারা প্রচন্ডভাবে চিৎকার করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম; হে জিবরাঈল! এরা কারা ? তখন তিনি বললেনঃ এরা ব্যভিচারী- যিনাকারী নারী ও পুরুষ”।
জাহান্নামের আগুনের ভয় যদি আমাকে থামাতে যথেষ্ট না হয়, তাহলে আমার দুনিয়াতেও তো ক্ষতি কম হচ্ছে না! যার সাথে প্রেম করছি, তার সাথেই যে আমার বিয়ে হবে তার কোনো গ্যারান্টি আছে? যদি না হয়, তাহলে ভুল মানুষের সাথে ভুল সময়ে, ভুল ভাবে জড়িয়ে যাবার মাশুল আমাকে দুনিয়াতেও দিতে হবে!
কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেছেন, ”লা তাকরাবাল যিনা” যার অর্থ “তোমরা যিনার ধারে-কাছেও যেও না।” যিনাহ মানে "অবিবাহিত দুইজন মানুষের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক।" নাউজুবিল্লাহ শুনতেই কতটা খারাপ শোনায়! আচ্ছা আমি তো আর ডিরেক্টলি যিনা করছিনা! শুধু ফোনে কথা বলা, ঘোরাঘুরি, একটু হাত ধরে বসে থাকা - এইতো! দেখো সারাহ, আল্লাহ শুধু বলেননি যে, "যিনা করো না!" বলেছেন, "এর ধরে কাছেও যেও না!" এই যে ফোনে ফিসফিসানি, হাতে হাত ধরে হাঁটাচলা - সবই তোমাকে যিনার অনেক কাছে নিয়ে যাচ্ছে। ইসলাম এমন একটা স্মার্ট জীবন ব্যবস্থা যে যেই কাজগুলি যিনার ধারেকাছেও নিয়ে যাবার সম্ভাবনা রাখে, আল্লাহ সেগুলি আগেভাগে করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। Prevention is better than cure! কত হতভাগী বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হয়ে গর্ভপাত করতে হসপিটালে ছোটে, কেউ নিরুপায় হয়ে অমানুষের মত নবজাতককে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় অথবা, লজ্জায় আত্মহত্যা করে পত্রিকায় হেডলাইন হয়। আল্লাহ মাফ করুক। চিন্তা করতে পারো তুমি এমন একটা পথে হাঁটছ যেই পথটা যেকোনো সময় কি রকমের ভয়ঙ্কর একটা মোড় নিতে পারে?
"নাহ! আমি তো নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি! আমি কখনোই এমন করবো না!" - এই ভয়ঙ্কর ভুল নিয়ে যেন কখনো না থাকি! এমন দুর্বল ঈমান নিয়ে এতো ওভারকনফিডেন্স দেখানো ভালো না! যেখানে আদম(আ:) শয়তানের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানে আমার মতো পাপী শয়তানের ফাঁদে পড়বে না কোন গ্যারান্টি আছে? একটা খালি রুম যোগাড় করা কোন ব্যপার? এখন থেকে নফসকে ট্রেইন না করলে ঐ কঠিন মুহূর্তে পড়লে কীভাবে নিজেকে বাঁচাবে? শয়তান চুলকানি দেওয়া শুরু করার আগেই এই পথ থেকে সরে আসো!
আবার বলছি- আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা যিনার ধারে কাছেও যেয়ো না: কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়।” (কুরআনঃ সূরা ১৭ (আল-ইসরা/বনি ইস্রাঈল)। ভালো করে পড়ো - একটা পাপ অন্যান্য অনেক পাপের দরজা খুলে দেয়! আমি এই পাপে লিপ্ত থাকলে অন্যান্য অনেক ভালো কাজই করতে পারি না! ঠিক মতো নামাজ পড়তে পারি না। পর্দার খেলাফ হয়ে যায়। আল্লাহ মাফ করুক! আমি কি চাই আমার ভালো কাজ করার দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাক?
শুধু চুড়ান্তভাবে শারীরিক সম্পৰ্কের নামই যিনা নয়! আল্লাহর রসূল (সা:) বলেছেন, "আদম সন্তানের উপর যিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু-চোখের যিনা হল (নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি) দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হল শ্রবণ করা, জিহবার যিনা হল কথোপকথন করা, হাতের যিনা হল স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হল হেঁটে যাওযা, অন্তরের যিনা হচ্ছে আকাংখা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ শেষ পর্যন্ত এই যিনাকে বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।" (সহীহ বুখারী, ৮:৭৭:৬০৯)
লেও ঠ্যালা! ওই ছেলে যতবার তোমার দিকে চোখ তুলে হা করে তাকিয়ে থাকে, তোমাদের চোখের যিনা হয়। কান দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে কানের যিনা! জিহবা দিয়ে "বাবু! বাবু!" করলে মুখের যিনা! হাতটা ধরে ফেললে হাতের যিনা! হেঁটে হেঁটে ওই পাপ কাজ করার পথে এগিয়ে যাওয়া পায়ের যিনা! অন্তরের যিনা হচ্ছে সারাক্ষন বয়ফ্রেন্ডের চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা। এতো যিনাহর ভার নিয়ে আল্লাহর সামনে কিয়ামতে দাঁড়ানোর সাহস আছে? না থাকলে সময় থাকতে থাকতে এখনই এসব বাদ দাও!"
ঠিক আছে ধরলাম এমন অনেকেই আছে যারা চুটিয়ে প্রেম করেছে, পড়াশোনাও ঠিক রেখেছে আবার এখন বিয়ে করে তারা অনেক ভালোও আছে। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তাদেরকে ভালো রাখুক। আমি কি তাদের মতো হতে চাই ? প্রথম কথা হচ্ছে, তারা আসলেই কতটা ভালো আছে সেটা ফেসবুকে একটা হাসিখুশি প্রোফাইল পিকচার দিয়ে বুঝা সম্ভব না। দুই, তারা দুনিয়াতে ভালো থাকলেও যদি তাওবা করে আল্লাহর কাছে ফেরত না যায়, তাহলে আখিরাতে তারা কেমন থাকবে সেটা আমি জানি না। এগেইন, আমি কি এমন অবস্থা নিয়ে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে চাই?
সবই বুঝলাম! বলা তো অনেক সহজ কিন্তু করতে পারাটা কঠিন! এতদিনের সম্পর্ক! কীভাবে সব ছেড়ে দিব?
সবার আগে সম্পর্কটাকে হালাল করার চেষ্টা করি। বিয়ে যদি সামনে ফিউচারে হবার সম্ভাবনা থাকে সেটাকে দ্রুত করা সম্ভব কি না সেই চেষ্টা করতে হবে। এই মুহূর্তে বিয়ে সম্ভব না হলে আমাকে বেশি বেশি নফল রোজা রাখতে হবে। নফস আর ডিসায়ারকে কন্ট্রোল করতে রোজা রাখা উত্তম।
সম্পর্ক হালাল না হওয়া পর্যন্ত বেশি বেশি যোগাযোগ, ঘোরাঘুরি একদম বন্ধ করে দেওয়া! আল্লাহ না করুক, যদি এই মানুষটার সাথে আমার বিয়ে তাকদির লেখা না থাকে, তাহলে আমি অন্য আরেকজনের ভবিষ্যৎ স্বামীর সাথে কথা বলছি, ঘুরছি, নিজের ইমোশন ইনভেস্ট করছি! কেন? ভাবতেই খারাপ লাগে।
বিয়ে শেষ পর্যন্ত তার সাথেই হবে আল্লাহ যার সাথে লিখে রেখেছেন। পুরো দুনিয়া একসাথে হয়েও সেটা থামাতে পারবে না বা চেঞ্জ করতে পারবেনা। তাহলে শুধু শুধু মাঝখান থেকে এসবে জড়িয়ে গুনাহ কামিয়ে লাভ টা কি?
আমি আজকেই ছেলেটাকে ব্লক করে দিচ্ছি। সব ফোন নম্বর থেকে। সোশাল মিডিয়া থেকে। দুর্বল হওয়া যাবে না। একবার ব্লক করে আবার আনব্লক করা যাবে না।
আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসলে রিসিভ করবে না। হতে পারে এটা তার নম্বর!
আল্লাহর কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখ। উপকারী বই পড়ো। তোমার কুরআন ক্লাসে আবার যাওয়া শুরু করো। পরিবারের বাচ্চাগুলিকে কুরআন পড়াও। ভালো কাজে ব্যস্ত থাক যেন শয়তান বেশি খুঁটানোর সুযোগ না পায়।
বেশি ইমোশনাল হয়ে ছেলেটার সাথে আবার কথা বলে ফেললে ইস্তিগফার করো। হতাশ হয়ে যেওনা। আবার গুনাহয় ডুবে যেও না। আল্লাহর কাছে ফিরে আসো। আবার এই নোটসটা বার বার পড়তে থাক। নিজেকে আল্লাহর ভালোবাসার কথাগুলি রিমাইন্ড করিয়ে দাও।
মন দুর্বল হয়ে গেলে "আউজুবিল্লাহি মিনাশশায় ত্বনির রাজিম" পড়ো! ওজু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যাও।
দুয়া করো যদি এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে যদি তোমার দ্বীন, দুনিয়া, আখিরাতের কল্যাণ থেকে থাকে, তাহলে আল্লাহ যেন তার সাথে তোমাকে পবিত্রভাবে মিলিয়ে দেন। আর যদি এই ছেলের সাথে বিয়ে হলে তোমার দ্বীন, দুনিয়া, আখিরাতের কোন কল্যাণ না থাকে, তাহলে যেন আল্লাহ তার এবং তোমার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন এবং আল্লাহর ডিসিশানের উপর তোমার অন্তরকে খুশি রাখেন। ভরসা কর আল্লাহর উপর এবং তাঁর হাতেই এটা তুলে দাও। নিজের হাতে গুনাহর ভার তুলে নিও না।
তুমি যদি আল্লাহকে খুশি রেখে কিছু ছেড়ে দাও, মনে প্রাণে বিশ্বাস করো যে, আল্লাহ তোমাকে এর থেকে লক্ষ কোটি গুণ বেশি ভালো প্রতিদান দিবেন। আখিরাতে তো দিবেনই, দুনিয়াতেও দিবেন।"
ডায়রি টা বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখল জয়া! হঠাৎ দুইমাস আগে কথা নেই, বার্তা নেই আসিফের সাথে ব্রেক-আপ করল সারাহ! তার অবশ্য এর বেশ কয়দিন আগে থেকেই সারাহ অদ্ভুত রকমের আচরণ করা শুরু করে। নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলে, ছেলেদের সাথে তেমন দরকার ছাড়া আর কথাই বলেনা! কত হাসাহাসি করেছে ক্যাম্পাসে সারাহকে নিয়ে! "হুজুরনি" বলে খেপিয়েছে, বকেছে, অপমান করেছে। সারাহ মেয়েটা একটা টুঁ শব্দটাও করেনি। এখন জয়ার নিজের কাছে ভীষণ খারাপ লাগছে! কেন জানি নিজের দু'চোখ বেয়ে পানির ফোঁটা পড়তে লাগল। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের আওয়াজে সংবিৎ ফিরে ফেল জয়া। স্ক্রিনে ভেসে উঠল সাকিবের ফোন নম্বার। সাকিব জয়ার বয়ফ্রেন্ড। কি করবে সে? নিজের নফসের ডাকে সাড়া দিবে? শয়তানের ফিসফিসানিতে সায় দিবে? নাকি আত্মশুদ্ধির পথে নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিবে?
ডিসিশান টা জয়াকেই নিতে হবে।
আপনাকেও নিতে হবে!
সমাপ্ত
লেখাঃ শারিন সফি অদ্রিতা (আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)
আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!
1 Comments
আমি একটা বিষয় নিয়ে অনেক প্রব্লেম এর মাজে আছি😢
ReplyDelete