তখনো আমাদের এদিকে করোনাভাইরাসের তান্ডব সেরকম জোরে-সোরে শুরু হয়নি। মসজিদ গুলি কেবল বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে। এমন সময় আমার জনাবের এক বড় ভাই মসজিদ বন্ধের ব্যাপারে খুব দুঃখ পোষণ করে বলছিলেন, "এটা কি হল ভাই? আমাদের আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে! ভাইরাসের ভয়ে মসজিদের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে! কেন ভাইয়া?" আমার জামাই দুঃখ করেই বললেন, "ভাই, মসজিদ বন্ধের জন্যে আমারও প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তবে এই নিয়ে আমাদের অন্যভাবে ভাবার সুযোগ আছে কি?" আরও কিছুক্ষণ তাদের আলাপ চললো। দুইজনের এই ব্যপারে দুই মত। যে যার জায়গায় অনড়! এক পর্যায়ে জামাই অসহায়ের মত হাসলেন এবং ভাবলেন যে, বড় ভাইকে তো সে আল্লাহর জন্যে ভালবাসেন। এখন আমরা ঝগড়াও করতে পারবো না, মারামারিও করতে পারবো না। সালাম দিয়ে ছেড়ে দিলেন। এই বেলা সেই পর্বের সমাপ্তি!
পরবর্তী কয়দিন আমাদের এখানে ছিল আরও অস্থির অবস্থা! লক-ডাউন সবে শুরু হচ্ছে তখন। আমরা স্টোরে গেলাম। বেশির ভাগ শেলফ ফাঁকা! এমন সময় জামাইয়ের চোখ পড়লো বেঁচে যাওয়া একমাত্র গুঁড়া দুধের টিনটার উপর। কৌটা হাতে নিয়ে আমাকে বললো, "অদ্রি! ঐ ভাই তার ছোট বাচ্চাদের জন্যে কোন দোকানেই গুঁড়া দুধ খুঁজে পাচ্ছিলেন না কিন্তু। এটা আমরা ভাইয়ের বাচ্চাদের জন্যে নিয়ে যাবো।" উল্লেখ্য, এই ভাই সেই একই ভাই যার সাথে আমার জনাবের কয়দিন আগে বড় রকমের মতভেদ হয়েছিল! আমরা বাজার শেষে ভাইয়ের বাসায় থেমে বাচ্চাদের জন্যে দুধের কৌটা পৌঁছে দিলাম। ভাই এত খুশি হলেন! অনেক দুয়া দিলেন! কে বলবে যে তাদের মধ্যে ২ দিন আগে কোন রকমের মতভেদ হয়েছিল?
জানেন কেন আজকে এই ঘটনা বলছি? মসজিদ বন্ধ করা উচিত নাকি অনুচিত সেটা নিয়ে কিছু বলবো না। ফিকহ এবং মাসআ'লা নিয়ে কথা বলার জন্যে বিজ্ঞ আলেমরা আছেন, সেটা বাস্তবায়নের জন্যে দেশের কর্তৃপক্ষ আছে। এরপর যার যার সিদ্ধান্ত তার তার এবং তার কর্মের জন্যে শুধুমাত্র সে নিজেই দায়ী থাকবে।
তবে আমাদের মসজিদ বন্ধের মত ব্যপারগুলি নিয়ে আমরা যে কথা কাটাকাটি- মারামারি গুলি করি - সেটার কি হবে? এই যে কোন ব্যপারে আমার মতের সাথে কারো একটু অমিল হলেই যে সেটা নিয়ে আমরা একজন আরেকজনকে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলি - এটা না করেও যে সুস্থ ভাবে ২ জন মানুষ ভিন্ন মত পোষণ করে একে অপরকে আল্লাহর জন্যে ভালোবেসে যেতে পারে এবং একজন আরেকজনের কল্যাণের জন্যে কাজ করে যেতে পারে সেটার জলজ্যান্ত উদাহরণ এখনও এই দুনিয়াতে আছে! এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট লাগে।
কষ্ট হবারই কথা। কারণ আমার মতের সাথে কেউ ভিন্ন মত পোষণ করবে? তাও দলিল দেখিয়ে? আমাকে ভুল বলবে? আমার সমালোচনা করবে? আমাদের পিত্তি জ্বলে যায়। তাকে এক হাত দেখিয়ে, পাল্টা রেফারেন্স দিয়ে কমেন্টের পর কমেন্ট করে, শেষমেশ অকথ্য ভাষায় গালাগালি! সামনাসামনি পরিবারের আপন মানুষেরা আমরা এই ব্যপারগুলি নিয়ে ঝগড়া করছি। হরহামেশাই অনলাইন-অফলাইনে এমন মারামারি দেখতে খুব কষ্ট লাগে। এভাবেই কি আমাদের মুসলিমদের নিজেদের মধ্যকার মতভেদ হ্যান্ডেল করার কথা?
আচ্ছা, আমাদের সাহাবীদের মধ্যে কি কখনো মতভেদ হয়েছিল? তখন তারা কি করতেন? একটা ঘটনা বলি। একবার রসূল(সাঃ) একদল সাহাবীদেরকে অর্ডার দিলেন যে, "বনু কুরাইদা নামক জায়গায় না যাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন আসরের সালাহ আদায় না করে।" পথের মধ্যে আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেল এবং বনু কুরাইদাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে নামাজের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিল। এই নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ হয়ে দুইটা দল হয়ে গেল। একদল বলল, রসূল(সাঃ) বুঝাতে চেয়েছেন যেন আমরা তাড়াতাড়ি সফর করি এবং নামাজের দেরী না করি। তাগিদ দিতেই কথাটা এভাবে বলা হয়েছে, তাই নামাজ দেরী না করে পথের মধ্যেই পড়ে ফেলা উচিত। আরেক দল বললেন যে, না! এখানে রসুল(সাঃ) লিটারেলি ঐ নির্দিষ্ট জায়গাতে গিয়েই নামাজ পড়ার কথা বলেছেন এবং রসূল(সাঃ)এর আদেশ আমরা অমান্য করতে পারি না। শেষমেশ একদল পথের মধ্যেই বিরতি নিয়ে আসর নামাজ পড়ে নিলেন। আরেকদল বনু কুরাইদাতে পৌঁছে তবেই নামাজ পড়লেন। যখন রসূল(সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল যে, তাদের মধ্যে কোন দল ঠিক? তিনি দুই দলকেই ঠিক বললেন! (১)
মানে বুঝতে পারছেন? আমাদের মতের সাথে কারো ভিন্ন মত থাকা মানেই সে ভুল না! হতে পারে দুইজনই যার যার জায়গায় ঠিক! হতে পারে ২ জনই ভুল!
এখানে লক্ষ করি, সাহাবীরা কিন্তু ঐ ঘটনায় মতভেদ নিয়ে ঝগড়া শুরু করেননি। একজন আরেকজনকে কাফের বলে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন নাই। গালি-গালাজ করেন নাই। ফিরে গিয়েছেন আল্লাহর রসূলের(সাঃ) কাছে কুরআন এবং সুন্নাহর ভিত্তিতে ফায়সালা ঠিক করতে!
দ্বীনের মেইন প্রিন্সিপালগুলো ঠিক রেখে ভিন্ন মতের ব্যখ্যা ইন্টারপ্রিটিশানের সুযোগ আছে। এজন্যে এত ঘৃণা? আমরা কবে আমাদের মুসলিম ভাইবোনদেরকে আসলেই আল্লাহর জন্যে ভালবাসতে শিখবো?
রসূল (সাঃ) এর কাছে তাঁর উম্মতের ঐক্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ! আর আমরা অনলাইন-অফলাইনে সেই ঐক্যের বারোটা বাজিয়ে বেড়াই। ক্রাইসিসের সময় যেখানে আমাদের আরও একসাথে হাতে হাতে মিলিয়ে কাজ করার কথা, সেখানে আমরা ইমোশনাল হয়ে আরও বেশি কাদা ছোড়াছুঁড়ি করি!
অনলাইন হচ্ছে তর্ক করার জন্যে খুব বাজে একটা জায়গা। স্ক্রিনের পিছনে লুকিয়ে মানুষ থেকে জানোয়ারের মত আচরণ শুরু করে দেওয়া খুব সহজ। অথচ সামনা সামনি থাকলে হয়ত এমন কথা আমরা বলতে পারতাম না। আমার এক খুব কাছের বান্ধবীর এক ফেসবুক পোস্টে একবার এক প্রফেসর শ্রেণীর মানুষ ইসলাম নিয়ে খুব খারাপ কথা বলছিলো। আমার বান্ধবী তাকে বলে, "স্যার! আমার বাসায় আপনার কফির দাওয়াত রইল। কফি খেতে খেতে ঠাণ্ডা মাথায় এই আলোচনা শেষ করা যাবে।" এই একটা কথাতে যত বড় ইসলামের দাওয়াত হয়েছে, একশো দলিলওয়ালা কমেন্ট দিয়ে সেটা হত না! প্লিজ অনলাইনে পাবলিক পোস্টে কারো সাথে লাগতে যাবেন না। কেউ ভুল করছে মনে হলে তাকে হিকমাহ সহকারে প্রাইভেটলি বলুন। ফোন করুন। সামনাসামনি কথা বলুন। আপনার- আমার ঐ সিচুয়েশানে বলার পজিশান কতটুকু আছে সেটা নিয়ে ভাবুন।
আল্লাহর খুশির জন্যে আমরা চুপ থাকা শিখি। যদি আমাদের ফিডব্যাক দিবার মত পজিশান থাকে, আমরা অনেস্ট ফিডব্যাক দিব। "গঠনমূলক সমালোচনার" নামে চেনা-অচেনা মুসলিম ভাইবোনদের চোখের পানির কারণ যেন আমরা না হই। এমনিতে আমরা কম বিপদ ডেকে আনি নাই নিজেদের জন্যে!
এই রমাদানকে সামনে রেখে আমরা নিজেদের দূরত্ব গুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারি কি? আল্লাহর খুশির জন্যে ঝগড়া-তর্ক নাহয় বাদ দিলাম?
যুগ যুগ ধরে এই মারামারি চলছে আমাদের মধ্যে - রোজা শুরু কোনদিন থেকে এই নিয়ে, তারাওয়ীর নামাজের রাকাআত সংখ্যা নিয়ে, ঈদের চাঁদ নিয়ে! এই দিকে করোনার যুগে মসজিদ বন্ধ নিয়ে মারামারি, কালোজিরা নিয়ে কথা কাটাকাটি, নিউজ নিয়ে, পলিটিক্স নিয়ে ঝগড়া! একজন আরেকজনকে খুব শুনিয়ে দেওয়া চলছেই চলবে। আল্লাহর ওয়াস্তে আমরা এই বেলা থামি।
করোনাভাইরাস আমাদের কিছু করতে পারুক বা না পারুক, মনে হয় এই কী-বোর্ড যুদ্ধে আর জিহ্বার ধার দিয়ে আমরা নিজেরাই একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবো!
ইয়া মাওলা, আপনি উম্মতের ঐক্য ফিরিয়ে দিন! আমিন।
❒ রেফারেন্সঃ
(১) সীরাহর গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ্য ঘটনাটা পাবেন। Also found in the book "Foundation of Shariah Governance" by Azhar Hamid.
লেখাঃ শারিন সফি অদ্রিতা (আল্লাহ্ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!)
আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক ইন শা আল্লাহ ’ লেখাটি শেয়ার করুন বন্ধুদের সাথে!
0 Comments